পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ কাঠামো ও আগ্নেয়গিরি

ভূ-অভ্যন্তর  ও আগ্নেয়গিরি
ভূ-অভ্যন্তর ও আগ্নেয়গিরি



আমাদের চোখের সামনে দৃশ্যমান এই পৃথিবী যেন একটি স্থির ও শান্ত গ্রহ। কিন্তু সত্যি কি তাই? বাস্তবে, এই ভূ-পৃষ্ঠের নিচে চলছে এক নিরব, কিন্তু তীব্র শক্তির খেলা — যেখানে বিরাজ করছে প্রচণ্ড তাপ, চাপ, এবং নিয়মিত পরিবর্তন। এই অভ্যন্তরের স্তরগুলো শুধু পৃথিবীর গঠন নয়, নির্ধারণ করে আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ভূপ্রাকৃতিক ঘটনাও — যেমন ভূমিকম্প, প্লেট সঞ্চালন, ও অগ্ন্যুৎপাত

এই ব্লগে আমরা এক ঝলকে দেখে নেব পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ কাঠামো ঠিক কেমন, কীভাবে এই স্তরগুলো একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত, এবং কীভাবে এসব পরিবর্তনের ফলেই সৃষ্টি হয় ভয়াবহ আগ্নেয়গিরি — যা একদিকে ধ্বংস ডেকে আনে, অন্যদিকে নতুন ভূমি ও জীবনচক্রের সূচনা করে।

চলো এবার গভীরে ডুব দিই পৃথিবীর অন্তর্লোকে... 🔥🌍


পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন সম্পর্কে জানার বিভিন্ন পরোক্ষ উৎস : 

পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন সম্পর্কে জানার জন্য বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পরোক্ষ উৎস ব্যবহার করেন, যেহেতু পৃথিবীর কেন্দ্রে সরাসরি পৌঁছানো সম্ভব নয়। এই পরোক্ষ উৎসগুলো নিম্নলিখিতভাবে তথ্য সরবরাহ করে:

  • তাপমাত্রা, চাপ এবং ঘনত্বের পরিবর্তন (Temperature, Pressure, and Density Changes): খনির কার্যকলাপ থেকে জানা যায় যে পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে ভেতরের দিকে যত গভীরে যাওয়া যায়, তাপমাত্রা এবং চাপ তত বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও, পদার্থের ঘনত্বও গভীরতার সাথে বাড়ে। পৃথিবীর মোট পুরুত্ব জানার কারণে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন গভীরতায় তাপমাত্রা, চাপ এবং পদার্থের ঘনত্বের মান অনুমান করতে সক্ষম হয়েছেন।
  • উল্কা (Meteors): মাঝে মাঝে যে উল্কাগুলো পৃথিবীতে এসে পৌঁছায়, সেগুলো বিশ্লেষণের মাধ্যমেও পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। যদিও এই উল্কাগুলো পৃথিবীর অভ্যন্তর থেকে আসে না, তবে এগুলোর গঠন এবং উপাদান পৃথিবীর মতোই বা অনুরূপ। তাই, উল্কাগুলো পৃথিবীর অভ্যন্তর সম্পর্কে তথ্যের একটি উৎস হিসেবে কাজ করে।
  • মাধ্যাকর্ষণ (Gravitation): পৃথিবীর পৃষ্ঠে বিভিন্ন অক্ষাংশে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি (g) একই থাকে না। মেরু অঞ্চলের কাছাকাছি মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বেশি এবং বিষুবরেখার কাছে কম হয়, কারণ বিষুবরেখা কেন্দ্রে থেকে মেরুর চেয়ে বেশি দূরে অবস্থিত। মাধ্যাকর্ষণ মান পদার্থের ভরের উপরও নির্ভর করে। পৃথিবীর অভ্যন্তরে পদার্থের অসম বন্টন এই মানকে প্রভাবিত করে। প্রত্যাশিত মানের সাথে মাধ্যাকর্ষণ পাঠের পার্থক্যকে গ্র্যাভিটি অ্যানোমালি (gravity anomaly) বলা হয়, যা পৃথিবীর ভূত্বকের মধ্যে পদার্থের বন্টন সম্পর্কে তথ্য দেয়।
  • চৌম্বক ক্ষেত্র (Magnetic Field): চৌম্বক জরিপগুলো পৃথিবীর ভূত্বকের চৌম্বকীয় পদার্থের বন্টন সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করে, যা এই অংশের পদার্থের বন্টন সম্পর্কেও জানতে সাহায্য করে।
  • ভূমিকম্পের কার্যকলাপ (Seismic Activity): এটি পৃথিবীর অভ্যন্তর সম্পর্কে তথ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসগুলির (one of the most important sources) মধ্যে একটি। ভূকম্পন তরঙ্গের অধ্যয়ন পৃথিবীর স্তরিত অভ্যন্তরীণ অংশের একটি সম্পূর্ণ চিত্র সরবরাহ করে।
    • ভূমিকম্প তরঙ্গ (Earthquake Waves): ভূমিকম্প তরঙ্গ মূলত দুই প্রকারের হয় – বডি ওয়েভ (body waves) এবং সারফেস ওয়েভ (surface waves)
      • বডি ওয়েভ (Body Waves): এগুলো ফোকাসে (যেখানে শক্তি নির্গত হয়) উৎপন্ন হয় এবং পৃথিবীর দেহ ভেদ করে সব দিকে ভ্রমণ করে।
        • P-তরঙ্গ (P-waves): এগুলো দ্রুত চলে এবং পৃষ্ঠে প্রথমে পৌঁছায়, তাই এদের প্রাথমিক তরঙ্গ (primary waves) বলা হয়। P-তরঙ্গগুলো শব্দ তরঙ্গের মতো এবং গ্যাসীয়, তরল ও কঠিন - সব ধরনের পদার্থের মধ্যে দিয়ে যেতে পারে।
        • S-তরঙ্গ (S-waves): এগুলো P-তরঙ্গের পরে পৃষ্ঠে পৌঁছায় এবং এদের সেকেন্ডারি তরঙ্গ (secondary waves) বলা হয়। S-তরঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, এরা শুধুমাত্র কঠিন পদার্থের (only through solid materials) মধ্যে দিয়ে ভ্রমণ করতে পারে। এই বৈশিষ্ট্য বিজ্ঞানীদের পৃথিবীর অভ্যন্তরের গঠন বুঝতে সাহায্য করেছে।
      • তরঙ্গের গতি এবং দিক পরিবর্তন (Changes in wave velocity and direction): তরঙ্গগুলো বিভিন্ন ঘনত্বের পদার্থের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করার সময় তাদের গতি পরিবর্তিত হয়। পদার্থ যত ঘন হয়, তরঙ্গের গতি তত বেশি হয়। এছাড়াও, তারা বিভিন্ন ঘনত্বের পদার্থের সম্মুখীন হলে প্রতিফলিত (reflect) বা প্রতিসরিত (refract) হওয়ার কারণে তাদের দিকও পরিবর্তিত হয়। সিসমোগ্রাফে তাদের রেকর্ড থেকে তরঙ্গের দিকের এই পরিবর্তনগুলো অনুমান করা হয়।
      • ছায়া অঞ্চল (Shadow Zone): ভূমিকম্প তরঙ্গগুলো সিসমোগ্রাফে রেকর্ড করা হয়, তবে কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলে তরঙ্গগুলো রিপোর্ট হয় না। এই অঞ্চলগুলোকে ছায়া অঞ্চল (shadow zone) বলা হয়।
        • সিসমোগ্রাফগুলো এপিসেন্টার (ভূমিকম্পের ফোকাসের ঠিক উপরে ভূপৃষ্ঠের বিন্দু) থেকে 105° এর মধ্যে P এবং S উভয় তরঙ্গই রেকর্ড করে।
        • তবে, এপিসেন্টার থেকে 145° এর বেশি দূরে অবস্থিত সিসমোগ্রাফগুলো P-তরঙ্গের আগমন রেকর্ড করে, কিন্তু S-তরঙ্গের নয়।
        • এপিসেন্টার থেকে 105° থেকে 145° এর মধ্যবর্তী অঞ্চলটি উভয় প্রকার তরঙ্গের জন্য ছায়া অঞ্চল (shadow zone) হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
        • 105° এর বাইরের সম্পূর্ণ অঞ্চলে S-তরঙ্গ পৌঁছায় না।
        • P-তরঙ্গের ছায়া অঞ্চল পৃথিবীর চারপাশে 105° থেকে 145° এর মধ্যে একটি ব্যান্ড হিসাবে দেখা যায়।
        • S-তরঙ্গের ছায়া অঞ্চল P-তরঙ্গের চেয়ে অনেক বড় এবং এটি পৃথিবীর পৃষ্ঠের প্রায় 40 শতাংশের বেশি জুড়ে বিস্তৃত।
      • এই P ও S-তরঙ্গের গতি, প্রতিসরণ, প্রতিফলন এবং বিশেষ করে S-তরঙ্গের তরল মাধ্যমের মধ্য দিয়ে যেতে না পারার বিষয়টি বিজ্ঞানীদের পৃথিবীর বহিঃস্থ কোর (outer core) তরল অবস্থায় রয়েছে তা বুঝতে সাহায্য করেছে।

ভূমিকম্পের তরঙ্গ এবং তাদের আচরণ পৃথিবীর গভীর স্তরের তথ্য প্রকাশ করার জন্য বিজ্ঞানীদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরোক্ষ উৎসগুলির মধ্যে একটি। পৃথিবীর অভ্যন্তর সম্পর্কে জানার জন্য এই তরঙ্গগুলি যেভাবে ব্যবহৃত হয়, তা নিচে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হলো:

  • ভূমিকম্প তরঙ্গের প্রকারভেদ এবং তাদের গতিশীলতা:

    • ভূমিকম্প তরঙ্গ প্রধানত দুই প্রকারের হয় – বডি ওয়েভ (Body Waves) এবং সারফেস ওয়েভ (Surface Waves)। বডি ওয়েভগুলি ফোকাস (যেখানে শক্তি নির্গত হয়) থেকে উৎপন্ন হয় এবং পৃথিবীর শরীর ভেদ করে সব দিকে ভ্রমণ করে। সারফেস ওয়েভগুলি পৃষ্ঠের শিলার সাথে বডি ওয়েভের মিথস্ক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন হয় এবং পৃষ্ঠ বরাবর চলে।
    • P-তরঙ্গ (P-waves): P-তরঙ্গগুলো দ্রুত চলে এবং পৃষ্ঠে প্রথম পৌঁছায়, তাই এদের প্রাথমিক তরঙ্গ (primary waves) বলা হয়। P-তরঙ্গগুলো শব্দ তরঙ্গের মতো এবং গ্যাসীয়, তরল ও কঠিন - সব ধরনের পদার্থের মধ্যে দিয়ে যেতে পারে। এগুলি প্রচারের দিকে পদার্থের সংকোচন ও প্রসারণ ঘটায়।
    • S-তরঙ্গ (S-waves): S-তরঙ্গগুলো P-তরঙ্গের পরে পৃষ্ঠে পৌঁছায় এবং এদের সেকেন্ডারি তরঙ্গ (secondary waves) বলা হয়। S-তরঙ্গের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, এরা শুধুমাত্র কঠিন পদার্থের (only through solid materials) মধ্যে দিয়ে ভ্রমণ করতে পারে। এই বৈশিষ্ট্য বিজ্ঞানীদের পৃথিবীর অভ্যন্তরের গঠন বুঝতে অনেক সাহায্য করেছে। S-তরঙ্গগুলি তাদের প্রচারের দিকের উল্লম্ব তলে কম্পন সৃষ্টি করে, যা পদার্থে ক্রেস্ট এবং ট্রাফ তৈরি করে।

  • তরঙ্গের গতি এবং দিকের পরিবর্তন:

  • তরঙ্গগুলো বিভিন্ন ঘনত্বের পদার্থের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করার সময় তাদের গতি পরিবর্তিত হয়। পদার্থ যত ঘন হয়, তরঙ্গের গতি তত বেশি হয়।
  • এছাড়াও, তারা বিভিন্ন ঘনত্বের পদার্থের সম্মুখীন হলে প্রতিফলিত (reflect) বা প্রতিসরিত (refract) হওয়ার কারণে তাদের দিকও পরিবর্তিত হয়। সিসমোগ্রাফে তাদের রেকর্ড থেকে তরঙ্গের দিকের এই পরিবর্তনগুলো অনুমান করা হয়।

  • ছায়া অঞ্চল (Shadow Zone) সৃষ্টি:

  • ভূমিকম্প তরঙ্গগুলো দূরে অবস্থিত সিসমোগ্রাফে রেকর্ড করা হয়, তবে কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলে তরঙ্গগুলো রিপোর্ট হয় না। এই অঞ্চলগুলোকে ছায়া অঞ্চল (shadow zone) বলা হয়।
  • ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র (epicentre) থেকে 105° দূরত্বের মধ্যে অবস্থিত সিসমোগ্রাফগুলো P এবং S উভয় তরঙ্গের আগমন রেকর্ড করে।
  • তবে, উপকেন্দ্র থেকে 145° এর বেশি দূরে অবস্থিত সিসমোগ্রাফগুলো P-তরঙ্গের আগমন রেকর্ড করে, কিন্তু S-তরঙ্গের নয়।
  • উপকেন্দ্র থেকে 105° থেকে 145° এর মধ্যবর্তী অঞ্চলটি উভয় প্রকার তরঙ্গের জন্য ছায়া অঞ্চল হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
  • 105° এর বাইরের সম্পূর্ণ অঞ্চলে S-তরঙ্গ পৌঁছায় না
  • P-তরঙ্গের ছায়া অঞ্চল পৃথিবীর চারপাশে 105° থেকে 145° এর মধ্যে একটি ব্যান্ড হিসাবে দেখা যায়।
  • S-তরঙ্গের ছায়া অঞ্চল P-তরঙ্গের চেয়ে অনেক বড় এবং এটি পৃথিবীর পৃষ্ঠের প্রায় 40 শতাংশেরও বেশি জুড়ে বিস্তৃত।

  • পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠনের তথ্য প্রকাশ:

  • P-তরঙ্গ এবং S-তরঙ্গের গতি, প্রতিসরণ, প্রতিফলন, এবং বিশেষ করে S-তরঙ্গের তরল মাধ্যমের মধ্য দিয়ে যেতে না পারার বিষয়টি বিজ্ঞানীদের পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ স্তর সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে।
  • S-তরঙ্গের একটি বৃহৎ ছায়া অঞ্চল এবং P-তরঙ্গের গতি পরিবর্তনের কারণে এটি স্পষ্ট হয়েছে যে পৃথিবীর বহিঃস্থ কোর (outer core) তরল অবস্থায় রয়েছে, কারণ S-তরঙ্গ তরলের মধ্য দিয়ে যেতে পারে না।
  • P-তরঙ্গের গতি পরিবর্তন এবং তাদের ছায়া অঞ্চলের উপস্থিতি ইঙ্গিত করে যে কোরের ভেতরে পদার্থের ঘনত্ব এবং অবস্থা পরিবর্তিত হয়, যা আন্তঃস্থ কোর (inner core) কঠিন অবস্থায় রয়েছে বলে ধারণা দেয়।

এভাবে ভূমিকম্পের তরঙ্গগুলির আচরণ, বিশেষ করে তাদের গতি, দিক পরিবর্তন এবং ছায়া অঞ্চলের সৃষ্টি, বিজ্ঞানীদেরকে পৃথিবীর ভূত্বক (crust), ম্যান্টল (mantle), এবং কোর (core) - এই তিনটি প্রধান স্তরের গঠন, উপাদান এবং ভৌত অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দিয়েছে।


পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ কাঠামো : 

পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ কাঠামোকে প্রধানত তিনটি স্বতন্ত্র স্তরে ভাগ করা হয়েছে: ভূত্বক (Crust), গুরুমন্ডল (Mantle), এবং কেন্দ্রমন্ডল (Core)। বিজ্ঞানীরা মূলত পরোক্ষ প্রমাণ, বিশেষ করে ভূমিকম্পের তরঙ্গ বিশ্লেষণ করে এই স্তরগুলো সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছেন।

পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ কাঠামো নিম্নরূপ:

  • ভূত্বক (The Crust):

    • এটি পৃথিবীর সর্বোচ্চ কঠিন অংশ এবং এর প্রকৃতি ভঙ্গুর
    • ভূত্বকের পুরুত্ব সমুদ্রতলের নিচে এবং মহাদেশীয় অঞ্চলে ভিন্ন হয়।
    • গড় সমুদ্রীয় ভূত্বকের পুরুত্ব ৫ কিমি, যখন মহাদেশীয় ভূত্বকের পুরুত্ব প্রায় ৩০ কিমি
    • প্রধান পর্বতশ্রেণীগুলির অঞ্চলে মহাদেশীয় ভূত্বক পুরু হয়, যেমন হিমালয় অঞ্চলে এটি ৭০ কিমি পর্যন্ত পুরু হতে পারে।

পৃথিবীর মহাদেশীয় ভূত্বক প্রধানত দুইটি স্তরে বিভক্ত:

  1. সিয়াল (SIAL) – উপরের স্তর

    🧱 নাম এসেছে Silicon (Si) + Aluminium (Al) থেকে।
    গঠন: হালকা, দানাদার শিলা (যেমন গ্রানাইট)।
    অবস্থান: ভূপৃষ্ঠের ঠিক নিচে।

  2. সিমা  (SIMA) – নিচের স্তর

    🧱 নাম এসেছে Silicon (Si) + Magnesium (Ma) থেকে।
     গঠন: ঘন, কঠিন শিলা (যেমন বাসল্ট)।
     অবস্থান: সিয়ালের নিচে এবং মোহো রেখার ওপরে।

  • গুরুমন্ডল (The Mantle):

    • গুরুমন্ডল ভূত্বকের নিচে থেকে ২,৯০০ কিমি গভীরতা পর্যন্ত বিস্তৃত
    • গুরুমন্ডলের উপরের অংশকে অ্যাস্থেনোস্ফিয়ার (asthenosphere) বলা হয়, যার অর্থ 'দুর্বল'। এটি প্রায় ৪০০ কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত বলে মনে করা হয়।
    • এই অ্যাস্থেনোস্ফিয়ারই হলো ম্যাগমার প্রধান উৎস, যা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের সময় পৃষ্ঠে উঠে আসে।
    • ভূত্বক এবং গুরুমন্ডলের উপরের অংশ মিলে লিথোস্ফিয়ার (lithosphere) গঠিত হয়, যার পুরুত্ব ১০-২০০ কিমি পর্যন্ত পরিবর্তিত হয়।
    • নিম্ন গুরুমন্ডল অ্যাস্থেনোস্ফিয়ারের বাইরে বিস্তৃত এবং এটি কঠিন অবস্থায় থাকে।
    • গুরুমন্ডলের ঘনত্ব ভূত্বকের চেয়ে বেশি। 

🌋  অ্যাসথেনোস্ফিয়ার (Asthenosphere) ঃ 

গুরুমন্ডল বা Mantle সম্পর্কে আমরা আগেই জেনেছি, এটি পৃথিবীর ভূত্বকের নিচে থাকা একটি বিস্তৃত স্তর, যা মূলত কঠিন কিন্তু কিছুটা চলমান পদার্থ দিয়ে গঠিত। এবার আমরা জানব গুরুমন্ডলের মধ্যেই থাকা একটি বিশেষ অঞ্চলের কথা, যার নাম — অ্যাসথেনোস্ফিয়ার (Asthenosphere)

🌍 অ্যাসথেনোস্ফিয়ার কী?

অ্যাসথেনোস্ফিয়ার হলো গুরুমন্ডলের উপরের অংশের নিচের একটি স্তর, যেখানে শিলাগুলো সম্পূর্ণ কঠিন নয় — বরং প্রচণ্ড তাপ ও চাপের কারণে তারা কিছুটা গলিত, নরম এবং প্লাস্টিকের মতো আচরণ করে।

এই স্তরটি এতটাই নমনীয় যে, এর ওপর ভাসে পৃথিবীর কঠিন টেকটোনিক প্লেটগুলো। ঠিক যেন কঠিন কাঠের টুকরো পানিতে ভেসে থাকে!

📍 অবস্থান:

  • এটি গুরুমন্ডলের উপরের ভাগের নিচের দিকে অবস্থিত।
  • এর অবস্থান সাধারণত ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০০ থেকে ৩৫০ কিমি গভীরে

🔥 বৈশিষ্ট্য:

  • এই স্তরটি আংশিক গলিত (partially molten) এবং ধীরে ধীরে প্রবাহিত হয়।
  • এর তাপমাত্রা অনেক বেশি, যা শিলাগুলোকে নরম করে দেয়।
  • এটি টেকটোনিক প্লেটগুলোর চলাচলের জন্য ভূমিকা রাখে, যার ফলে হয় ভূমিকম্প, মহাদেশ সঞ্চালন ও আগ্নেয়গিরির উদগীরণ
🎯 সংক্ষেপে বলা যায়:

  •  গুরুমন্ডলের এক অংশ
  • ১০০–৩৫০ কিমি গভীরে
  • আংশিক গলিত, নমনীয় শিলা
  • টেকটোনিক প্লেট চলার জন্য সহায়ক
  • ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা

  • কেন্দ্রমন্ডল (The Core):

    • ভূমিকম্প তরঙ্গের গতি বিশ্লেষণ করে পৃথিবীর কেন্দ্রমন্ডলের অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেছে।
    • গুরুমন্ডল-কেন্দ্রমন্ডল সীমানা ২,৯০০ কিমি গভীরতায় অবস্থিত।
    • কেন্দ্রমন্ডলের বাইরের অংশ তরল অবস্থায় থাকে। (আমাদের পূর্বের কথোপকথনে উল্লেখ করা হয়েছে যে S-তরঙ্গ তরলের মধ্য দিয়ে যেতে না পারায় এবং একটি বড় ছায়া অঞ্চল তৈরি করায় এই তরল অবস্থার প্রমাণ পাওয়া যায়)।
    • কেন্দ্রমন্ডলের ভেতরের অংশ কঠিন অবস্থায় থাকে।
    • কেন্দ্রমন্ডল অত্যন্ত ভারী উপাদান দিয়ে গঠিত, যার মধ্যে প্রধানত নিকেল এবং লোহা থাকে। একে কখনও কখনও 'নিফে' (nife) স্তর হিসাবে উল্লেখ করা হয়।

🎯  এবার আমরা জানব পৃথিবীর অভ্যন্তরের বিযুক্তি রেখা সম্পর্কে

ওপরের  আলোচনায় আমরা পৃথিবীর অভ্যন্তরের তিনটি প্রধান স্তর — ভূত্বক (Crust),  গুরুমন্ডল  (Mantle)  এবং কেন্দ্র (Core) সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জেনেছি।  প্রতিটি স্তরের রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, ঘনত্ব ও উপাদানভিত্তিক গঠন। তবে এই স্তরগুলোর মাঝে এমন কিছু সীমান্ত রেখা রয়েছে, যেগুলোতে হঠাৎ পরিবর্তন ঘটে পৃথিবীর উপাদান, ঘনত্ব এবং ভূকম্প তরঙ্গের গতিতে। এই সীমান্ত রেখাগুলোকেই বলা হয় "বিযুক্তি রেখা" বা Discontinuities

এই বিযুক্তি রেখাগুলি ভূতাত্ত্বিক ও ভূকম্পবিদ্যায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সেগুলো পৃথিবীর অভ্যন্তরের গঠন বুঝতে এক একটি 'চাবিকাঠি'র মতো কাজ করে। কোথায় একটি স্তর শেষ হয়ে আরেকটি স্তর শুরু হয়েছে — তা নির্ধারণ করতে বিজ্ঞানীরা ভূকম্প তরঙ্গের গতি ও আচরণ বিশ্লেষণ করে এই রেখাগুলোর অস্তিত্ব শনাক্ত করেছেন।

এই আলোচনায় আমরা পৃথিবীর অভ্যন্তরের গুরুত্বপূর্ণ বিযুক্তি রেখাগুলি যেমন মোহোরোভিসিচ (Moho), গুটেনবার্গ (Gutenberg), লেহম্যান (Lehmann) ইত্যাদি নিয়ে বিস্তারিতভাবে জানব — তারা কোথায় অবস্থিত, কত গভীরে, এবং কী বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে তারা চিহ্নিত হয়।

চলো, তাহলে শুরু করি পৃথিবীর অভ্যন্তরের এই রহস্যঘেরা বিভাজন রেখাগুলোর একটি সুসংগঠিত ব্যাখ্যা।

১. মোহোরোভিসিচ বিচ্ছেদ রেখা (Moho Discontinuity)

এটি পৃথিবীর ভূত্বক (crust) ও গুরুমন্ডল (mantle) এর মধ্যে অবস্থিত। এই রেখাটি আবিষ্কার করেন ক্রোয়েশিয়ার ভূকম্পবিদ Andrija Mohorovičić ১৯০৯ সালে।

🔹 অবস্থান: ভূত্বক ও গুরুমন্ডল সংযোগস্থলে।

🔹 গভীরতা:

  • মহাসাগরের নিচে ৫ থেকে ১০ কিলোমিটার,
  • মহাদেশের নিচে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ কিলোমিটার।

🔹 বিশেষত্ব:
এই রেখায় ভূকম্প তরঙ্গ (P ও S তরঙ্গ) হঠাৎ গতি বাড়িয়ে ফেলে। এর কারণ হলো ভূত্বক থেকে mantle-এর উপাদান ঘনত্বে ও গঠনে পরিবর্তন ঘটে। ভূত্বক অপেক্ষাকৃত হালকা ও সিলিকা সমৃদ্ধ, আর mantle বেশি ঘন ও ম্যাগনেসিয়াম-লোহা সমৃদ্ধ।

২. রেপিটি বিচ্ছেদ রেখা (Repetti Discontinuity)

এই রেখা সম্পর্কে তুলনামূলকভাবে কম তথ্য পাওয়া যায় এবং এটি সব জায়গায় নেই বলে এটি কিছুটা বিতর্কিত।

🔹 অবস্থানগুরুমন্ডল উপরের ও নিম্ন স্তরের (upper and lower mantle) মাঝখানে।

🔹 গভীরতা: আনুমানিক ৬৭০ থেকে ৭০০ কিলোমিটার।

🔹 বিশেষত্ব:
এই রেখায় ভূকম্প তরঙ্গের গতি এবং গঠন উপাদানের বৈশিষ্ট্য বদলায়। ধারণা করা হয়, এই রেখার নিচে mantle-এর ঘনত্ব ও তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যায়, এবং সেখান থেকে প্লেট টেকটনিক গতির সূচনা হয়।

৩. গুটেনবার্গ বিচ্ছেদ রেখা (Gutenberg Discontinuity)

এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রেখা যা পৃথিবীর কঠিন গুরুমন্ডল ও তরল বাইরের কেন্দ্রের (Outer Core) মাঝে রয়েছে। এটি আবিষ্কার করেন জার্মান ভূকম্পবিদ Beno Gutenberg

🔹 অবস্থান: Mantle ও Outer Core-এর সীমান্তে।

🔹 গভীরতা: প্রায় ২৯০০ কিলোমিটার।

🔹 বিশেষত্ব:
এখানে ভূকম্পের S-তরঙ্গ সম্পূর্ণভাবে থেমে যায়। এর কারণ হলো বাইরের কেন্দ্র (Outer Core) সম্পূর্ণরূপে তরল ধাতব পদার্থ (প্রধানত লোহা ও নিকেল) দিয়ে গঠিত। S-তরঙ্গ তরলে চলতে পারে না, তাই এই রেখা থেকে তাদের গতি বন্ধ হয়ে যায়। আবার, P-তরঙ্গের গতি কমে যায় ও বিকৃত হয়।

এই পরিবর্তন আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে বাইরের কেন্দ্র তরল অবস্থায় রয়েছে।

৪. লেহম্যান বিচ্ছেদ রেখা (Lehmann Discontinuity)

এটি বাইরের তরল কেন্দ্র ও অভ্যন্তরীণ কঠিন কেন্দ্রের (Inner Core) মধ্যে অবস্থিত একটি বিযুক্তি রেখা। এই রেখা আবিষ্কার করেন ডেনমার্কের ভূকম্পবিদ Inge Lehmann ১৯৩৬ সালে।

🔹 অবস্থান: Outer Core ও Inner Core-এর মাঝে।

🔹 গভীরতা: আনুমানিক ৫১০০ কিলোমিটার।

🔹 বিশেষত্ব:
এই রেখায় P-তরঙ্গের গতি আবার বাড়ে এবং কিছু S-তরঙ্গ প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, পৃথিবীর অন্তস্থ কোর কঠিন। যদিও বাইরের কোর তরল, এই কঠিন অংশে ভূকম্প তরঙ্গের গতি বাড়ে।

৫. অন্যান্য ক্ষুদ্র বিযুক্তি রেখা

✅ Mantle-এর অভ্যন্তরেও কিছু ছোট ছোট বিযুক্তি রেখা পাওয়া যায় যেখানে ভূমিকম্প তরঙ্গের গতি বা দিক হঠাৎ পরিবর্তিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২২০ কিমি এবং ৪০০ কিমি গভীরতায় কিছু বিভাজক স্তর রয়েছে যেগুলোর গঠন ও গুণাগুণ নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে।

এই বিযুক্তি রেখাগুলো আমাদের পৃথিবীর অভ্যন্তরের গঠন বুঝতে সহায়তা করে। ভূকম্প তরঙ্গের গতি ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন কোথায় কোন উপাদান রয়েছে, কোনটি কঠিন বা তরল এবং সেই অনুযায়ী পৃথিবীর গঠনচিত্র তৈরি হয়।

বিভিন্ন প্রকার আগ্নেয়গিরি এবং তাদের দ্বারা সৃষ্ট ভূমি গঠনের প্রক্রিয়াগুলি :

বিভিন্ন প্রকার আগ্নেয়গিরি (Types of Volcanoes) আগ্নেয়গিরিগুলিকে অগ্ন্যুৎপাতের প্রকৃতি এবং ভূপৃষ্ঠে সৃষ্ট ভূমিরূপের উপর ভিত্তি করে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। প্রধান প্রকারগুলি হল:

  • শিল্ড আগ্নেয়গিরি (Shield Volcanoes):

  • এগুলি পৃথিবীতে সমস্ত আগ্নেয়গিরির মধ্যে বৃহত্তম (বাসাল্ট প্রবাহ ব্যতীত)।
  • হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের আগ্নেয়গিরিগুলি এর সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ।
  • এগুলি মূলত বাসাল্ট দিয়ে তৈরি, যা অগ্ন্যুৎপাতের সময় অত্যন্ত তরল থাকে।
  • এই কারণে, এই আগ্নেয়গিরিগুলি খাড়া হয় না।
  • যদি কোনোভাবে জল এর গভীরে প্রবেশ করে, তবে এগুলি বিস্ফোরক হয়ে উঠতে পারে; অন্যথায়, এগুলি কম-বিস্ফোরক প্রকৃতির হয়।
  • আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত লাভা ফোয়ারার মতো বেরিয়ে এসে ভেন্টের উপরে শঙ্কু তৈরি করে, যা সিন্দার কোণে (cinder cone) বিকশিত হয়।
  • কম্পোজিট আগ্নেয়গিরি (Composite Volcanoes):

    • এগুলি বাসাল্টের চেয়ে ঠান্ডা এবং বেশি সান্দ্র লাভা (cooler and more viscous lavas) দ্বারা চিহ্নিত।
    • এই আগ্নেয়গিরিগুলি প্রায়শই বিস্ফোরক অগ্ন্যুৎপাতের (explosive eruptions) কারণ হয়।
    • লাভার সাথে প্রচুর পরিমাণে পাইরোক্লাস্টিক পদার্থ (pyroclastic material) এবং ছাই মাটিতে এসে জমা হয়।
    • এই পদার্থগুলি ভেন্টের কাছাকাছি স্তরে স্তরে জমা হয়ে কম্পোজিট আগ্নেয়গিরি (composite volcanoes) তৈরি করে।
    • ক্যালডেরা (Caldera): এগুলি পৃথিবীর সবচেয়ে বিস্ফোরক আগ্নেয়গিরি। এরা এতটাই বিস্ফোরক যে অগ্ন্যুৎপাতের সময় উঁচু কাঠামো তৈরি না করে নিজেরাই ধসে পড়ে। ধসে পড়া এই অবনমিত অংশগুলিকে ক্যালডেরা বলা হয়। এদের বিস্ফোরকতা নির্দেশ করে যে লাভা সরবরাহকারী ম্যাগমা প্রকোষ্ঠটি বিশাল এবং ভূপৃষ্ঠের খুব কাছাকাছি।

  • ফ্লাড বাসাল্ট প্রোভিন্স (Flood Basalt Provinces):

  • এই আগ্নেয়গিরিগুলি অত্যন্ত তরল লাভা নির্গত করে যা দীর্ঘ দূরত্বে প্রবাহিত হয়।
  • বিশ্বের কিছু অংশ হাজার হাজার বর্গ কিলোমিটার পুরু বাসাল্ট লাভা প্রবাহ দ্বারা আবৃত।
  • এখানে একাধিক প্রবাহ থাকতে পারে, যার কিছু প্রবাহের পুরুত্ব ৫০ মিটারের বেশি হয়।
  • ভারতের ডেকান ট্র্যাপ (Deccan Traps), যা বর্তমানে মহারাষ্ট্র মালভূমির বেশিরভাগ অংশ জুড়ে রয়েছে, একটি অনেক বড় ফ্লাড বাসাল্ট প্রদেশ।

  • মধ্য-মহাসাগরীয় শৈলশিরা আগ্নেয়গিরি (Mid-Ocean Ridge Volcanoes):

  • এই আগ্নেয়গিরিগুলি মহাসাগরীয় অঞ্চলে (oceanic areas) দেখা যায়।
  • একটি ৭০,০০০ কিমি দীর্ঘ মধ্য-মহাসাগরীয় শৈলশিরা ব্যবস্থা রয়েছে যা সমস্ত মহাসাগরীয় অববাহিকার মধ্য দিয়ে প্রসারিত।
  • এই শৈলশিরার কেন্দ্রীয় অংশে ঘন ঘন অগ্ন্যুৎপাত ঘটে।

আগ্নেয় ভূমি রূপ (Volcanic Landforms) আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের সময় নির্গত লাভা শীতল হয়ে আগ্নেয় শিলায় পরিণত হয়। এই শীতলীকরণ ভূপৃষ্ঠে বা ভূত্বকের মধ্যে লাভা থাকা অবস্থায় ঘটতে পারে। লাভার শীতলীকরণের স্থান অনুসারে, আগ্নেয় শিলাগুলিকে ভলক্যানিক শিলা (volcanic rocks) (পৃষ্ঠে শীতলীকরণ) এবং প্লুটোনিক শিলা (plutonic rocks) (ভূত্বকের গভীরে শীতলীকরণ) হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। ভূত্বকের মধ্যে শীতল হওয়া লাভা বিভিন্ন রূপ ধারণ করে। এই রূপগুলিকে অন্তর্বর্তী রূপ (intrusive forms) বলা হয়।

প্রধান অন্তর্বর্তী রূপগুলি হল:

  • বাথোলিথ (Batholiths):

  • এগুলি হল ম্যাগমেটিক পদার্থের একটি বৃহৎ অংশ যা ভূত্বকের গভীরে শীতল হয়ে বৃহৎ গম্বুজের আকারে বিকশিত হয়।
  • উপরে থাকা পদার্থগুলি ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ার পরেই কেবল এগুলি ভূপৃষ্ঠে দেখা যায়।
  • এগুলি বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত হয় এবং কখনও কখনও কয়েক কিলোমিটার গভীরতা পর্যন্ত পৌঁছায়।
  • এগুলি গ্র্যানিটিক দেহ (granitic bodies) এবং ম্যাগমা প্রকোষ্ঠগুলির শীতল অংশ।

  • ল্যাকোলিথ (Lacoliths):

  • এগুলি হল বৃহৎ গম্বুজ আকৃতির অন্তর্বর্তী দেহ যা একটি সমতল ভিত্তি এবং নীচ থেকে একটি পাইপ-সদৃশ নালী দ্বারা সংযুক্ত।
  • এগুলি দেখতে কম্পোজিট আগ্নেয়গিরির পৃষ্ঠের আগ্নেয় গম্বুজের মতো হলেও, এগুলি গভীর স্থানে অবস্থিত।
  • এগুলিকে লাভা সরবরাহকারী একটি স্থানীয় উৎস হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে যা ভূপৃষ্ঠে পৌঁছায়।
  • কর্ণাটক মালভূমি গ্রানাইট শিলার গম্বুজাকার পাহাড় দ্বারা চিহ্নিত, যার বেশিরভাগই ল্যাকোলিথ বা বাথোলিথের উদাহরণ।

  • ল্যাপোলিথ (Lapolith), ফাকোলিথ (Phacolith) এবং সিল (Sills):

  • যখন লাভা উপরের দিকে চলে, তার একটি অংশ অনুভূমিক দিকে প্রবাহিত হতে পারে যেখানে এটি একটি দুর্বল স্তর খুঁজে পায়। এটি বিভিন্ন রূপে বিশ্রাম নিতে পারে।
  • যদি এটি আকাশের দিকে অবতল একটি সসার আকৃতির দেহ (saucer shape, concave to the sky body) তৈরি করে, তবে এটিকে ল্যাপোলিথ (lapolith) বলা হয়।
  • ভাঁজ করা আগ্নেয় অঞ্চলে সিনক্লাইনের গোড়ায় বা অ্যান্টিক্লাইনের শীর্ষে কখনও কখনও অন্তর্বর্তী শিলার একটি তরঙ্গায়িত ভর পাওয়া যায়। এই তরঙ্গায়িত পদার্থগুলির নীচে ম্যাগমা প্রকোষ্ঠ (যা পরবর্তীতে বাথোলিথ হিসাবে বিকশিত হয়) পর্যন্ত একটি নির্দিষ্ট নালী থাকে। এগুলিকে ফাকোলিথ (phacoliths) বলা হয়।
  • অন্তর্বর্তী আগ্নেয় শিলাগুলির প্রায় অনুভূমিক দেহগুলিকে তাদের পুরুত্বের উপর নির্ভর করে সিল (sill) বা শিট (sheet) বলা হয়। পাতলাগুলিকে শিট এবং পুরু অনুভূমিক জমাগুলিকে সিল বলা হয়।

  • ডাইক (Dykes):

    • যখন লাভা ভূত্বকের ফাটল এবং ফাটলের মধ্য দিয়ে উপরে উঠে আসে, তখন এটি প্রায় ভূমির সাথে লম্বভাবে কঠিন হয়ে যায়।
    • এটি একই অবস্থানে শীতল হয়ে একটি প্রাচীর-সদৃশ কাঠামো (wall-like structure) তৈরি করে।
    • এই ধরনের কাঠামোকে ডাইক (dykes) বলা হয়।
    • এগুলি পশ্চিম মহারাষ্ট্র অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় এমন অন্তর্বর্তী রূপ।
    • এগুলি ডেকান ট্র্যাপ তৈরির অগ্ন্যুৎপাতের জন্য ফিডার (feeders) হিসাবে বিবেচিত হয়।

📝 উপসংহার (Conclusion):

পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ কাঠামো আমাদের চোখের আড়ালে থাকা এক বিস্ময়কর জগৎ। ভূত্বক, গুরুমন্ডল ও কেন্দ্র – এই তিনটি স্তরের মাঝখানে রয়েছে নানা ধরণের বিযুক্তি রেখা, যেগুলো পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক কার্যকলাপের মূল চাবিকাঠি। এসব স্তরের গঠন, উপাদান ও তাপমাত্রার তারতম্যের ফলে সৃষ্টি হয় ভূমিকম্প, প্লেট টেকটনিকস, এবং অগ্ন্যুৎপাত

অগ্নেয়গিরি যেমন একদিকে ধ্বংস ডেকে আনে, তেমনি নতুন ভূমির সৃষ্টি এবং উর্বর মাটির উৎসও বটে।এই দুটি বিষয়ের বিশ্লেষণ আমাদের পৃথিবীকে ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করে এবং বোঝায় যে আমাদের গ্রহটি কেবল একটি নিঃস্তব্ধ পাথরের গোলক নয়, বরং তা এক জীবন্ত, পরিবর্তনশীল ও সক্রিয় কাঠামো। 

Post a Comment

Previous Post Next Post