📘 পাত সংস্থান তত্ত্ব: Plate Tectonic Theory

Plate Tectonic Theory 

SLST 2025 ভূগোল পরীক্ষাকে সামনে রেখে প্রস্তুতি নেওয়া প্রত্যেকের জন্য “পাত সংস্থান তত্ত্ব” একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ  টপিক। সামনেই স্কুল সার্ভিস কমিশনের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। আশা করি তোমরা যারা এই পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করবে তোমরা তোমাদের পড়াশোনা খুবই যত্ন সহকারে চালিয়ে যাচ্ছ। তোমাদের প্রস্তুতিকে আরও একটু সহজ করার জন্য আমার এই ছোট প্রয়াস। আজকের আলোচনায়  আমরা “পাত সংস্থান তত্ত্ব” Plate Tectonic Theory নিয়ে  বিস্তারিত আলোচনা করব।  এই তত্ত্বের মাধ্যমে পৃথিবীর ভূত্বক গঠনের প্রক্রিয়া, পাত চলাচল, ভূমিরূপ গঠন, ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরির উৎপত্তি সম্পর্কে বিশদভাবে ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। বর্তমান ভূগাঠনিক ব্যাখ্যার ভিত্তি এই তত্ত্বের উপরই গড়ে উঠেছে। আজ আমরা পাতের ধরন, পাত সীমানায় সৃষ্ট ভূমিরূপ, পাতের গতি ও এর কারণ এবং তত্ত্বটির সমালোচনাসহ সমস্ত বিষয়গুলি সহজ, তথ্যবহুল ও পরীক্ষাভিত্তিকভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি । আশা করি, এটি তোমার প্রস্তুতিতে সহায়ক হবে। তাহলে চল শুরু করি ... 

🔰 ভূমিকা (Introduction)

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকে পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক গঠন, মহাদেশ ও মহাসাগরের অবস্থান এবং পরিবর্তনশীল প্রকৃতি নিয়ে নানা তত্ত্ব ও ধারণা উঠে এসেছে।
বিশেষত, ১৯৬০-এর দশকে মহাসাগরের তলদেশ সম্পর্কে আধুনিক গবেষণা ও ডেটা সংগ্রহ শুরু হলে বিজ্ঞানীরা উপলব্ধি করেন যে পৃথিবীর ভূত্বক আসলে একটি অখণ্ড নয়, বরং অনেকগুলো খণ্ডে বিভক্ত – যাদের প্রত্যেকটি স্থির নয় বরং গতিশীল।

🧠 আলফ্রেড ওয়েগনারের অবদান:

জার্মান ভূবিজ্ঞানী আলফ্রেড ওয়েগনার ১৯১২ সালে ‘মহীসঞ্চালন তত্ত্ব’ (Continental Drift Theory) দেন, যেখানে তিনি বলেন, মহাদেশগুলো একসময় যুক্ত ছিল এবং পরবর্তীতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
যদিও এই তত্ত্ব অনেকটা যৌক্তিক ছিল, কিন্তু তিনি মহাদেশ চলার প্রকৃত চালিকা শক্তি ব্যাখ্যা করতে পারেননি।
এর ফলে ওয়েগনারের তত্ত্ব অনেকটাই সমালোচিত হয়, যদিও এটি পরবর্তী 'পাত সংস্থান তত্ত্ব'-এর ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

🌍 পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গি:

পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা উপলব্ধি করেন, শুধুমাত্র মহাদেশ নয় – সমগ্র ভূত্বক (যার মধ্যে মহাদেশ ও মহাসাগরের তলদেশ উভয়ই আছে) চলমান।বিশেষত, মধ্য-সমুদ্রীয় শৈলশিরার (Mid-Oceanic Ridge) মতো স্থান থেকে নবীন লাভা বেরিয়ে আসা এবং সমুদ্রতলের ক্রমপ্রসারণ দেখে স্পষ্ট হয় – ভূত্বক কেবল সম্প্রসারিতই হচ্ছে না, বরং কোথাও তা আবার নিমজ্জিতও হচ্ছে।

এতসব পর্যবেক্ষণের ফলে ভূবিজ্ঞানীরা মেনে নেন যে —
👉 পৃথিবীর ভূত্বক অনেকগুলো পৃথক "পাত" বা প্লেট দ্বারা গঠিত, এবং এই পাতগুলি চলমান।
👉 এই চলাচল থেকেই ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরি, পর্বত গঠন ইত্যাদি ভূগাঠনিক ঘটনা ঘটছে।

---

🔍 পাতের অর্থ ও উৎপত্তি (Meaning and Origin of Plate)

📜 ইতিহাস:

• ১৯৬৫ সালে কানাডার ভূবিজ্ঞানী J. T. Wilson প্রথম ‘Plate’ শব্দটি ব্যবহার করেন Nature পত্রিকায়।
• পরে D. Mackenzie ও R. L. Parker (১৯৬৭) এই পাতের গঠন ও গতিশীলতা নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন।
• ১৯৬৮ সালে, ফরাসি ভূবিজ্ঞানী Xavier Le Pichon পাত সংস্থান তত্ত্বকে এক পূর্ণাঙ্গ ও গৃহীত ভূ-তাত্ত্বিক মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।

📖 শব্দের উৎস:

• “Tectonic” শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘Tekton’ থেকে, যার অর্থ গঠনকারী (builder)।
• অনেকে বলেন, এটি এসেছে ‘Tektonikos’ থেকে, যার অর্থ অট্টালিকা বা নির্মাণ।
• এই শব্দ থেকেই এসেছে ‘Plate Tectonics’ — যার আক্ষরিক অর্থ, পৃথিবীর গঠনের সাথে যুক্ত পাত বা খণ্ডসমূহের চলন সংক্রান্ত তত্ত্ব।

---

🧩 পাত সংস্থান তত্ত্ব কী বোঝায়?

পাত সংস্থান তত্ত্ব এক ধরনের ভূতাত্ত্বিক মডেল, যা পৃথিবীর লিথোস্ফিয়ার (Lithosphere) কে বিভিন্ন প্লেটে বিভক্ত বলে মনে করে।
এই প্লেটগুলি ম্যান্টলের উপরের স্তর (Asthenosphere)-এর উপর ভেসে থাকে এবং তাপীয় সঞ্চালনের ফলে চলমান অবস্থায় থাকে।

এই তত্ত্বের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়—

• মহাদেশ কীভাবে সরে যায়
• কেন ভূমিকম্প হয়
• আগ্নেয়গিরি কেন সক্রিয় হয়
• পর্বত কীভাবে গঠিত হয়
• সমুদ্রতল প্রসারণ বা সংকোচনের কারণ কী

উপাদান	ব্যাখ্যা
📅 প্রথম ব্যবহার	১৯৬৫, J. T. Wilson
📚 উন্নত মডেল	১৯৬৮, Xavier Le Pichon
🧠 শব্দ উৎস	গ্রিক ‘Tekton’ = গঠনকারী
🌍 অর্থ	পৃথিবীর ভূত্বক বিভিন্ন চলমান প্লেট বা পাত দিয়ে গঠিত
📌 উদ্দেশ্য	পৃথিবীর গঠন ও পরিবর্তনশীল বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করা

পৃথিবীর বাইরের শক্ত স্তর — লিথোস্ফিয়ার (Lithosphere) — পুরোপুরি একটানা নয় বরং এটি বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন ও শক্ত প্লেট বা পাত দ্বারা গঠিত।
প্রতিটি পাতের নিচে রয়েছে আস্থেনোস্ফিয়ার (Asthenosphere), যেটি আংশিক গলিত এবং তার উপর ভেসে থাকে লিথোস্ফিয়ার।

🧩 এ ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয় যখন দেখা যায় মধ্য-সমুদ্রীয় শৈলশিরা বা ভূমিকম্প-প্রবণ অঞ্চলগুলিতে ভূত্বক প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে।

📚 পাতের অস্তিত্বের প্রমাণ (Evidence of Plate Existence)

পাত সংস্থান তত্ত্ব কেবল ধারণা নয় — এর পিছনে গভীর বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ ও প্রমাণ রয়েছে। নিচে তা বিশ্লেষণ করে দেওয়া হলো:

---

✅ ১. ম্যাগমার উদ্গিরণ ও নবীন ভূত্বক গঠন

Tuzo Wilson দেখিয়েছেন, সামুদ্রিক শৈলশিরায় নতুন ম্যাগমা বেরিয়ে আসছে — যা নতুন ভূত্বক গঠন করছে।

✅ ২. বেনিয়ফ বলয় ও ভূমিকম্পের গভীরতা

যেখানে একটি পাত অন্যটির নিচে যাচ্ছে, সেখানে বিভিন্ন গভীরতায় ভূমিকম্প হয়।
এটি পাতের নিমজ্জন ও গঠনের সাক্ষ্য দেয়।

✅ ৩. প্রসারণ ও সংঘর্ষ অঞ্চল

যে অঞ্চলগুলিতে প্লেটগুলো একে অপর থেকে দূরে যাচ্ছে বা সংঘর্ষ হচ্ছে, সেখানে পাত সীমানার উপস্থিতি নিশ্চিত হয়।

✅ ৪. মধ্য-সমুদ্রীয় শৈলশিরায় গর্ত বা রিফ্ট ভ্যালি

Tuzo Wilson আইসল্যান্ডে রিফ্ট ভ্যালি আবিষ্কার করেন — যা পাত বিচ্ছিন্নতার অন্যতম প্রমাণ।

✅ ৫. শিলা-বিন্যাস

সমুদ্রের তলায় পুরনো শিলা না পাওয়া ও নবীন শিলার আধিক্য প্রমাণ করে, ভূত্বক সেখানে নতুন।

✅ ৬. বিপরীত চৌম্বক ক্ষেত্র

শৈলশিরার দুই পাশে শিলায় চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের বিপরীত দিক দেখায়, প্লেট দ্বিমুখী সঞ্চালনের প্রমাণ।

✅ ৭. ট্রান্সফর্ম চ্যুতি ও ভৌগলিক রূপান্তর

বিপরীত দিকে সরমান চ্যুতি বা ফ্র্যাকচার জোনগুলিও পাতের চলাচলের প্রমাণ দেয়।

✅ ৮. চৌম্বক ক্ষেত্র ও আগ্নেয়গিরির স্থান

পাতসীমানা বরাবর আগ্নেয়গিরি রৈখিকভাবে অবস্থান করে — এটি চলন্ত পাতের ফল।

---

🧠 সংক্ষিপ্তভাবে মনে রাখার কৌশল:

“ম্যাগমা-ভূকম্প-শিলা-বিপরীত চৌম্বক-আগ্নেয়গিরি” — এই পাঁচটি শব্দ মনে রাখলেই তুমি সহজেই পাতের অস্তিত্বের বৈজ্ঞানিক প্রমাণগুলো মনে রাখতে পারবে।

🌍 পাত সংস্থান তত্ত্বে পাতসীমানার প্রকারভেদ ও পাতের গতি

(Types of Plate Boundaries and Movements in Plate Tectonics)

---

🔹 ১. প্রতিসারী / অপসারী / গঠনকারী পাতসীমানা

(Divergent or Constructive Plate Boundary)

📌 সংজ্ঞা:

যে সীমানা বরাবর দুটি ভূত্বকীয় পাত পরস্পরের থেকে দূরে সরে যায়, তাকে প্রতিসারী বা অপসারী পাতসীমানা বলে। এখানে পাতগুলির মাঝখান দিয়ে ম্যাগমা উঠে এসে নতুন ভূত্বক তৈরি করে।

⚙️ কীভাবে কাজ করে:

• যখন দুটি পাত বিপরীত দিকে সরে যায়, তখন ওই সীমানায় চাপ কমে যায়।
• এই কম চাপের ফলে, গভীর ভূ-অভ্যন্তরের কঠিন পদার্থ তরলে পরিণত হয়ে লাভা হিসেবে নির্গত হয়।
• সেই লাভা ঠান্ডা হয়ে নতুন সমুদ্রতল গঠন করে।
• এইভাবে ধাপে ধাপে মধ্য-সামুদ্রিক শৈলশিরা (Mid-Oceanic Ridge) তৈরি হয়।

🌋 ভূগঠনের দিক:

• এখান থেকে তৈরি হয় নতুন সামুদ্রিক ভূত্বক।
• এই অঞ্চলগুলোতে সামান্য ভূমিকম্প এবং বড় আকারের আগ্নেয়গিরি সৃষ্টি হয়।

📍 উদাহরণ:

• মধ্য আটলান্টিক শৈলশিরা (Mid-Atlantic Ridge)
• ইস্ট আফ্রিকান রিফট ভ্যালি (East African Rift Valley)

---

🔹 ২. অভিসারী / ধ্বংসাত্মক / সংঘর্ষ সীমানা

(Convergent or Destructive Plate Boundary)

📌 সংজ্ঞা:

যে সীমানা বরাবর দুটি পাত পরস্পরের দিকে অগ্রসর হয়ে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, তাকে অভিসারী পাতসীমানা বলে।

⚙️ কীভাবে কাজ করে:

• দুটি পাত মুখোমুখি এলে একটি পাত অন্যটির নিচে চলে যায় – যাকে subduction (নিমজ্জন) বলে।
• এই নিমজ্জনের ফলে প্রচণ্ড চাপ ও তাপে শিলা গলে গিয়ে লাভা ও আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি হয়।
• একইসঙ্গে তৈরি হয় ভূকম্প ও গভীর সমুদ্রখাত। 

🌋 ভূগঠনের দিক:

• প্রবল ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি হয়।
• তৈরি হয় নবীন ভঙ্গিল পর্বতশ্রেণি, গভীর সমুদ্রখাত।

📍 উদাহরণ:

• জাপান ট্রেঞ্চ, হিমালয়, আন্দিজ পর্বতমালা

সংঘর্ষের ধরন	ফলাফল
a. মহাসাগরীয় + মহাদেশীয় পাত	ভারী মহাসাগরীয় পাত নিমজ্জিত হয়, পাহাড় ও আগ্নেয়গিরি গঠিত হয়। 🗻 যেমন: আন্দিজ পর্বতমালা
b. মহাসাগরীয় + মহাসাগরীয় পাত	এক পাত অন্যটির নিচে ঢোকে, ফলে আগ্নেয় দ্বীপমালা তৈরি হয়। 🏝️ যেমন: জাপান দ্বীপপুঞ্জ
c. মহাদেশীয় + মহাদেশীয় পাত	উভয় পাত মুখোমুখি চাপ পেয়ে ভাঁজ হয়ে পর্বত গঠন করে। ⛰️ যেমন: হিমালয় পর্বতশ্রেণি

---

🔹 ৩. নিরপেক্ষ / সংরক্ষণশীল পাতসীমানা

(Neutral or Conservative Plate Boundary)

📌 সংজ্ঞা:

যে পাতসীমানায় দুটি পাত পরস্পরের পাশে পাশে সরে যায়, কিন্তু তারা একে অপরের মুখোমুখি বা বিপরীত দিকে সরে যায় না — তাকে নিরপেক্ষ বা সংরক্ষণশীল সীমানা বলে।

⚙️ কীভাবে কাজ করে:

• পাত দুটি সমান্তরালভাবে সরে যায়, ফলে এখানে নতুন ভূত্বক তৈরি হয় না বা পুরোনো ভূত্বক ধ্বংসও হয় না।
• তবে এই অঞ্চলে ঘর্ষণের ফলে প্রচণ্ড ভূমিকম্প হতে পারে।

⚠️ ভূগঠনের দিক:

• এখানে হয় না নতুন শিলা সঞ্চার, কিন্তু দেখা যায় বিপজ্জনক চ্যুতি ও ভূমিকম্প।

📍 উদাহরণ:

• সান আন্দ্রিয়াস ফল্ট, ক্যালিফোর্নিয়া (San Andreas Fault)
• এখানে প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেট এবং উত্তর আমেরিকান প্লেট পার্শ্বচ্যুতি বরাবর সরে যাচ্ছে।

🌍 পাতের চলন ও এর কারণ

(Plate Movement and Its Causes)

---

🔹 পাতের চলন (Plate Movement)

পাত সংস্থান তত্ত্ব অনুসারে, পৃথিবীর শিলামণ্ডল বা ভূত্বক কিছু বিচ্ছিন্ন শক্তিশালী প্লেটে বিভক্ত, যেগুলি স্থির নয়, বরং চলমান।

• এই পাতগুলির কেন্দ্রীয় অঞ্চল তুলনামূলকভাবে স্থির হলেও প্রান্তবর্তী অঞ্চল সবসময় গতিশীল।
• বিজ্ঞানীরা ভূকম্প কেন্দ্রের অবস্থান বিশ্লেষণ করে পাতের সীমান্ত ও গতিপথ নির্ধারণ করেছেন।

📏 গতি:

• প্রতি বছর পাতগুলি ১ থেকে ৬ সেন্টিমিটার পর্যন্ত সরে যেতে পারে।
• নিরক্ষীয় অঞ্চলে গতি সর্বাধিক – ১০ থেকে ১২ সেন্টিমিটার/বছর।
• মেরু অঞ্চলে এই গতি প্রায় ০।

⚠️ পাতের চলন বিভিন্ন ফলাফলের কারণ:

• কখনো তারা পরস্পর থেকে দূরে সরে যায় (Divergent)
• কখনো মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয় (Convergent)
• আবার কখনো পাশে পাশে সরে যায় (Transform/Neutral)

---

🔎 পাতের গতির কারণ (Causes of Plate Movement)

পাতগুলোর চলন সম্পূর্ণভাবে ভূ-অভ্যন্তরের জটিল প্রক্রিয়াসমূহের উপর নির্ভরশীল। ভূবিজ্ঞানীরা একাধিক কারণ ব্যাখ্যা করেছেন যেগুলোর সম্মিলিত প্রভাবে এই চলন ঘটে:

---

✅ ১. পরিচলন স্রোত (Convection Current)

• Arthur Holmes প্রথম এই ধারণা দেন।
• অ্যাসথেনোস্ফিয়ারের গরম তরল পদার্থের উপর-নিচে চলাচল করার ফলে পরিচলন কোশ (Convection Cell) তৈরি হয়।
• এই কোশগুলো শিলামণ্ডলে চাপ দেয়, ফলে প্লেটগুলি একে অপর থেকে সরে যায় বা একে অপরের দিকে এগোয়।

🧪 এই স্রোত হল পাত চলাচলের সবচেয়ে মূল চালিকাশক্তি।

---

✅ ২. অভিকর্ষ টান বা ঢালবল (Gravitational Pull or Slab Suction)

• সমুদ্রের শৈলশিরা থেকে গভীর সমুদ্রখাতের দিকে একটি ঢাল সৃষ্টি হয়।
• অভিকর্ষ বলের তারতম্যের কারণে প্লেটগুলি শৈলশিরা থেকে নীচের দিকে সরে যায়।

📌 এটি পাতগুলিকে সরে যেতে সাহায্য করে ঢাল বরাবর।

---

✅ ৩. প্লিউম তত্ত্ব (Plume Theory)

• পৃথিবীর অভ্যন্তরে অবস্থিত Hot Spots থেকে উত্থিত ম্যাগমার উর্ধ্বমুখী প্রবাহকে বলে Plume।
• এরা নিচ থেকে চাপ দিয়ে উপরের প্লেটগুলোকে উত্তোলন ও সরানোর কাজ করে।

🔥 এই প্লিউম থেকে আগ্নেয় দ্বীপমালা, উদাহরণ: হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ।

---

✅ ৪. টান বল বা স্ল্যাব পুল (Slab Pull)

• যখন একটি পাত অন্যটির নিচে Subduction হয়, তখন তার নিচে ঢুকে যাওয়া অংশের ঘনত্ব বাড়ে।
• এই বাড়তি ঘনত্ব একটি নিচের দিকে টান বল সৃষ্টি করে, যা পুরো প্লেটকে টেনে নেয়।

⚠️ এটি পাত সংঘর্ষ সীমান্তে অত্যন্ত সক্রিয়।

---

✅ ৫. রিজ পুশ বল (Ridge Push Force)

• মাঝ সমুদ্রীয় শৈলশিরা অঞ্চলে লাভা নির্গত হয়ে নতুন পাত তৈরি করে।
• এই নতুন ভূত্বক উঁচু অবস্থানে থাকে, ফলে নিচু দিকের পাতকে চাপ দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়।
• এই চাপকে Ridge Push বলে।

🗻 এটি গঠনকারী বা অপসারী পাতসীমান্তে কার্যকর।

---

📘 পাতসীমানায় গঠিত ভূমিরূপ ও ভূগাঠনিক বৈশিষ্ট্য

(Landforms Associated with Plate Boundaries & Tectonic Features)

---

🔶 অপসারী পাতসীমানা (Divergent Plate Boundary)

📌 বৈশিষ্ট্য: দুটি পাত পরস্পর থেকে দূরে সরে যায়।

✅ ভূমিরূপ ও ঘটনাবলি:

1.সামুদ্রিক শৈলশিরা (Oceanic Ridge)

• মাঝ সমুদ্রীয় ফাটল বরাবর গলিত ম্যাগমা উঠে এসে নতুন ভূত্বক তৈরি করে।
• যেমন: মধ্য আটলান্টিক শৈলশিরা

2. চ্যুতি ও গ্রস্ত উপত্যকা (Fault & Rift Valley)

• পাত সরায় ফলে শিলায় টান পড়ে, ফলে সংকীর্ণ উপত্যকা ও হ্রদ গঠিত হয়।
• যেমন: পূর্ব আফ্রিকার গ্রেট রিফট ভ্যালি, আইসল্যান্ডের গ্রস্ত উপত্যকা

3. নতুন সমুদ্রের সৃষ্টি (New Ocean)

• দীর্ঘসময় অপসারণ চললে ফাটল অংশে জল ঢুকে সমুদ্র গঠিত হয়।
• যেমন: লোহিত সাগর, এডেন সাগর

4. ভূমিকম্প

• ফাটল অঞ্চলে ভূকম্পন ঘন ঘন হয়।

🔶 অভিসারী পাতসীমানা (Convergent Plate Boundary)

📌 বৈশিষ্ট্য: দুটি পাত মুখোমুখি এগিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।

📍 সংঘর্ষভেদে ভূমিরূপ গঠন:

▶️ A. মহাসাগরীয় + মহাদেশীয় পাত

1.অগ্ন্যুৎপাত ও আগ্নেয় বৃত্তমালা

• নিমজ্জিত পাত থেকে তৈরি গলিত ম্যাগমা উঠে আগ্নেয়গিরি সৃষ্টি করে।

• যেমন: অ্যান্ডিজ পর্বতের আগ্নেয় বৃত্তমালা

2.অধঃপাত বলয় (Subduction Zone)

• ভারী পাত হালকা পাতের নিচে ৩০°-৮০° কোণে ঢোকে।

3.সমুদ্রখাত (Ocean Trench)

• নিমজ্জনের ফলে গভীর সমুদ্র খাত তৈরি হয়।

• যেমন: পেরু-চিলি খাত

4.বেনিয়ফ অঞ্চল (Benioff Zone)

• এখান থেকে গভীর ও মাঝারি ভূমিকম্প হয়।

5.ভঙ্গিল পর্বত

• পলি সংকুচিত হয়ে ভাঁজ খেয়ে পর্বতে রূপ নেয়।

• যেমন: আন্দিজ, রকি

---

▶️ B. মহাদেশীয় + মহাদেশীয় পাত

1. ভঙ্গিল পর্বত

• দুটি পাত মুখোমুখি চাপ পেয়ে টেথিসের পলি সংকুচিত হয়ে ভাঁজ খেয়ে উপরে উঠে যায়।

• যেমন: হিমালয়, আল্পস

2. সুচার লাইন (Suture Line)

• যেখানে দুটি মহাদেশীয় পাত যুক্ত হয়।

3. ফ্লেক টেকটনিক্স (Flake Tectonics)

• হালকা প্লেট ভারী প্লেটের উপর চাপা পড়ে যায়।

4. ভূমিকম্প

• পর্বত গঠন সম্পূর্ণ না হওয়ায় মাঝে মধ্যেই ভূমিকম্প হয়।

▶️ C. মহাসাগরীয় + মহাসাগরীয় পাত

1.গভীর সমুদ্রখাত

• যেমন: মারিয়ানা খাত, সুন্দা খাত

2. ভূমিকম্প

• গভীর কেন্দ্রে শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়।

3.অগ্নেয় দ্বীপমালা (Island Arc)

• পাত নিমজ্জনের ফলে ধনুকাকৃতি আগ্নেয় দ্বীপমালা গঠিত হয়।

• যেমন: জাপান, টোঙ্গা দ্বীপপুঞ্জ

---

🔶 নিরপেক্ষ পাতসীমানা (Conservative Plate Boundary)

📌 বৈশিষ্ট্য: দুটি পাত পাশাপাশি ঘষা খেয়ে সরে যায়।

✅ ভূগাঠনিক বৈশিষ্ট্য:

1.ট্রান্সফর্ম চ্যুতি (Transform Fault)

• দুই পাতের পাশ কাটানোর ফলে দীর্ঘ চ্যুতি হয়।

• যেমন: সান আন্দ্রিয়াস চ্যুতি (ক্যালিফোর্নিয়া)

2.ভূমিকম্প

• ঘর্ষণের ফলে ঘন ঘন ভূমিকম্প হয়।

---

❗ পাত ভূগাঠনিক তত্ত্বের সমালোচনা (Criticism of Plate Tectonic Theory)

পাত সংস্থান তত্ত্ব সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য হলেও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে—

1.ভূত্বকের সৃষ্টি ও বিনাশে অসামঞ্জস্য

• প্লেট সৃষ্টির তুলনায় নিমজ্জনের এলাকা ছোট হওয়ায় ভারসাম্য নেই।

2.সবখানে বেনিয়ফ-জোন নেই

• যেমন: উত্তর আমেরিকার কিছু অঞ্চলে গভীর ভূমিকম্প বা বেনিয়ফ জোন অনুপস্থিত।

3.সব পর্বতের ব্যাখ্যা দেয় না

• যেমন: অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার কিছু পর্বত

4.পাত কিভাবে তৈরি হল, তার ব্যাখ্যা নেই

• প্লেট সৃষ্টির উৎস ও প্রকৃত কারণ অজানা।

5.গতিশীলতার সুনির্দিষ্ট বল অনুপস্থিত

• বিভিন্ন তত্ত্ব থাকলেও কোনটি প্রভাবশালী তা স্পষ্ট নয়।

                 পাত সংস্থান তত্ত্ব শুধু একটি জটিল ভূগাঠনিক তত্ত্ব নয়, এটি বর্তমান ভূবিজ্ঞানের ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। SLST পরীক্ষায় এই অধ্যায় থেকে প্রশ্ন আসার সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি। তাই শুধুমাত্র মুখস্থ না করে প্রতিটি ধারণা চিত্রসহ বুঝে নেওয়াই হবে তোমার সবচেয়ে বড় সাফল্যের চাবিকাঠি। আমাদের এই ব্লগ পোস্টের তথ্য ও বিশ্লেষণ যদি তোমার প্রস্তুতিতে কাজে আসে, তবে শেয়ার করতে ভুলো না এবং লেখাপড়া ব্লগে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পড়তে নিয়মিত ভিজিট করো।

✅ পরবর্তী পোস্টে আমরা এই অধ্যায় ভিত্তিক MCQ সেট এবং উত্তর বিশ্লেষণ নিয়ে আসব। সাথেই থাকো।
✍️ ভালো করে পড়ো, মনোযোগ দিয়ে বোঝো—সাফল্য তোমার হবেই।